২৬ জুন, ২০০০: একটি স্বপ্নপূরণের দিন

২৬ জুন, ২০০০। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সেরা প্রাপ্তির দিন। যে দিনে একটি ঘোষণার মাধ্যমেই বাংলাদেশের সর্বস্তরে ক্রিকেট খেলার দুয়ার খুলে যায়। তবে টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এর পিছনে কার অবদান বেশি ছিল জানেন? সাবের হোসেন চৌধুরী। উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন ব্লগ ঘেটে সেই স্মরণীয় দিনটির পেছনের কিছু গল্প শোনাই....

১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে বিসিবি সভাপতি নির্বাচিত হবার পরে প্রথম বোর্ড মিটিং সাবের হোসেন চৌধুরী তার ইচ্ছার কথা জানিয়ে একটা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কথা জানান সবাইকে। বিসিবির সেই কমিটিতে সেক্রেটারী ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল হক, পরিচালক ছিলেন আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি।

 টেস্ট স্ট্যাটাসের স্বপ্ন দেখার পর বিষয়টা অনেকটা কৌতুকের মতো ছিলো। কেউই বিশ্বাস করেনি এটা সম্ভব। সাবেক এক ক্রিকেটার নাকি সভাপতিকে বলেছিলেন “সাবের তুমি তো মজা করে বলছো কথাটা তাইনা? এটাতো বাস্তবে সম্ভব না। আইসিসি কেন আমাদের এখন টেস্ট স্ট্যাটাস দিবে?”

 এই কেন দিবে এটাই ছিলো একটা অফ-ফিল্ড রাজনীতির বিষয়। সেই সময় টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার জন্য কোন নির্দিষ্ট নিয়ম ছিলোনা। এখন যেমন আছে যে টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার আগে সেই দেশের ঘরোয়া চারদিনের ম্যাচের প্রথম শ্রেনীর মর্যাদা পেতে হবে। বাংলাদেশের পূর্বে টেস্ট স্ট্যাটাস পায় জিম্বাবুয়ে, ১৯৯২ সালে। তারা কারন হিসেবে দেখিয়েছিলো তিন বার আইসিসি ট্রফি জেতার পরেও যদি টেস্ট স্ট্যাটাস না পায় তাহলে জিম্বাবুয়েতে ক্রিকেটের মৃত্যু হবে। বাংলাদেশ কি বলবে? বলার জন্য তো আগে কিছু করা লাগে! তখন কোচ হিসেবে আনা হয় গর্ডন গ্রিনিজকে। টার্গেট করা হয় ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি। পরের অংশটা আশাকরি সবাই জানেন। বাংলাদেশ কেনিয়াকে পরাজিত করে আইসিসি ট্রফি জেতে এবং ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায়। একই সাথে হাতে আসে বিশ্বকাপে খেলার টিকেট। সেদিনের কথা যাদের মনে আছে তারা নিশ্চয় জানেন সেটা ছিলো আমাদের দেশে ক্রিকেটের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় উৎসব। সারা বাংলাদেশ ছিলো রং মাখামাখি আর মিছিলের দেশ।

 "We are going for Test Status" আইসিসি ট্রফি জেতার পরই সেই সময়ের আইসিসির সিইও ডেভিড রিচার্ডকে এভাবেই বলেন ঐ সময়ের বিসিবি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অকৃত্রিম বন্ধু বলা হয় জগমোহন ডালমিয়াকে। তিনি সেই সময় ছিলেন আইসিসি প্রেসিডেন্ট। তিনি বাংলাদেশের ব্যাপারে অত্যন্ত পজিটিভ ছিলেন। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জয়ের পর বাংলাদেশের প্রথম পদক্ষেপ ছিলো ঘরের মাটিতে বড় টুর্নামেন্ট আয়োজন করা। প্রথম পদক্ষেপ ছিলো ১৯৯৮ সালে স্বাধীনতা কাপ আয়োজন। স্বাধীনতার ২৫ বছর উপলক্ষ্যে আয়োজন করা ওই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারত অংশ নেয়। বেস্ট-থ্রি ফাইনালে ভারত ও পাকিস্তান প্রথম দুই ফাইনালে এক বার করে জেতার পর ৩য় এবং চ্যাম্পিয়ন নির্ধারনী ফাইনালে ভারত জয় পায়। তারপর বাংলাদেশে আয়োজন করা হয় প্রথম আইসিসি নকআউট বা মিনি বিশ্বকাপ (যেটা আজকের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি)। আট দলের সেই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ খেলেনি, প্রথম আট দল খেলেছিলো। মূলত এই টুর্নামেন্ট প্রমাণ করে দেয় বাংলাদেশ আইসিসি’র পূর্ণ সদস্যপদ পাবার যোগ্যতা রাখে। মাঠভর্তি দর্শক খেলাটার আর্থিক বিষয়গুলা ফুটিয়ে তোলে। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া আইসিসি’র এক আশীর্বাদ ছিলো। তা না হলে ক্রিকেটের জন্য বাংলাদেশ কতখানি উপযুক্ত সেটা হয়তো বিশ্বকে বোঝাতে অনেক দেরি হয়ে যেত আমাদের।

 ১৯৯৮ সালের মে মাসেই ভারত, বাংলাদেশ এবং কেনিয়াকে নিয়ে একটা ট্রাই নেশন কাপ হয়। এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ প্রথম ওয়ানডেতে জয়লাভ করে। হায়দ্রাবাদে কেনিয়াকে ৬ উইকেটে হারায় বাংলাদেশ। সেই সময় কেনিয়া বাংলাদেশের তুলনায় শক্তিশালী না হলেও দূর্বল ছিলোনা। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বিধ্বস্ত করা কেনিয়া এই টুর্নামেন্টেই আবার ভারতকে হারিয়ে দেয়। যাইহোক, চার ম্যাচের তিন ম্যাচে হেরে প্রথম পর্ব থেকেই বিদায় নেয় বাংলাদেশ।

 ১৯৯৯ বিশ্বকাপের আগে ঢাকায় আয়োজন করা হয় মেরিল কাপ। জিম্বাবুয়ে, কেনিয়া এবং বাংলাদেশ অংশ নেয় এতে। বাংলাদেশ গ্রুপ পর্বের চার ম্যাচই হেরে যায়। বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরী এখানেই।

 এরপর ১৯৯৯ বিশ্বকাপ। সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে ইতিহাস তৈরী করে বাংলাদেশ। হারায় স্কটল্যান্ডকেও।

 মূলত ১৯৯৮ সালেই মিনি বিশ্বকাপের সময় জগমোহন ডালমিয়া এবং সাউথ আফ্রিকা ক্রিকেটের প্রধান আলি বুখারের সাথে আলোচনায় সাবের চৌধুরী এবং আশরাফুল হক তাদের বুঝিয়ে দেন ক্রিকেটের বিশ্বায়নের জন্য বাংলাদেশের চেয়ে উত্তম জায়গা আর নেই। এতো দর্শকের ব্যবসায়িক দিক নিয়েও আলোচনা হয়। কেবলমাত্র এই জনপ্রিয়তা এবং অবকাঠামো না থাকায় একসময় বাংলাদেশের প্রবল প্রতিপক্ষ কেনিয়া কোনদিন টেস্ট স্ট্যাটাস পায়নি আর এখন হারিয়েই গেছে বলা যায়।

 ১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর সাবের চৌধুরী জগমোহন ডালমিয়াকে অনুরোধ করেন টেস্ট স্ট্যাটাসের পক্ষে ভোটাভুটির আয়োজন করার জন্য। ডালমিয়া সাবেরকে বলেন ওই মুহুর্তে ভোট দিলে বাংলাদেশ কেবল ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকার ভোট পেতে পারে। বাকিদের ভোট পাবার জন্য বাংলাদেশকে টেবিল রাজনীতি করতে হবে। অর্থাৎ, সাউথ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়াকে রাজি করাতে হবে। নয় পূর্ন সদস্যের ভেতর অন্তত সাতটা ভোট দরকার! সেই সময় বাংলাদেশের কোচ হয়ে আসে এডি বারলো, এডি বারলোর মাধ্যমে আলি বুখারের সাহায্যে নিশ্চিত হয় সাউথ আফ্রিকার ভোট। সাবের চৌধুরী নিজে সাউথ আফ্রিকা ভ্রমনে যান। একই সময়ে তিনি অস্ট্রেলিয়ার গিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে অনুরোধ করেন পাশে থাকার জন্য। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ দল কিছু আনঅফিশিয়াল ম্যাচ খেলার জন্য নিউজিল্যান্ড যায়। নিউজিল্যান্ড এর ঘরোয়া দলগুলার সাথে প্রথম শ্রেনীর ম্যাচ খেলে। নিউজিল্যান্ডকে ম্যানেজ করার কাজটা তখনই করা হয়। ১৯৯৯ সালে ইয়ান বিশপের ওয়েস্ট ইন্ডিজ আনঅফিশিয়াল ম্যাচ খেলতে ঢাকায় আসে (ভারত সফরের প্রস্তুতি হিসেবে)। একটা ম্যাচে এনামুল হক মনি পাঁচ উইকেট নেন। সেসময় ইয়ান বিশপ মন্তব্য করেন বাংলাদেশ টেস্ট খেলার যোগ্য। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইয়ান বিশপকে বলা হয় তিনি যেন ফিরে গিয়ে ওয়েস্ট বোর্ডের প্রধান প্যাট রসুকে অনুরোধ করেন বাংলাদেশের পাশে থাকার। বিশপ কথা রেখেছিলেন। আর জিম্বাবুয়ের প্রধান পিটার চিকোগাকে রাজি করানো হয় মেরিল কাপ চলার সময়। একমাত্র ইংল্যান্ডের সমর্থন নিশ্চিত ছিলোনা।

 টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার জন্য ১৯৯৯-২০০০ সালে চালু হয় জাতীয় ক্রিকেট লীগ। মাঠ স্বল্পতার কারনে ঢাকা, চট্টগ্রামের পাশাপাশি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ হলের মাঠ ইত্যাদি মাঠেও খেলা হয়। যদিও এই ম্যাচ গুলার প্রথম শ্রেনীর মর্যাদা ছিলোনা। বাংলাদেশের ঘরোয়া চার দিনের ম্যাচ প্রথম শ্রেনীর মর্যাদা পায় বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাবার পরে। এর ভেতর ২০০০ সালের শুরুতে আইসিসি ৩ সদস্যের পরিদর্শক দল পাঠায় ঢাকায়। তারা সবকিছু দেখে পজিটিভ রিপোর্ট দেয় আইসিসিকে। পরিদর্শক দল ঢাকায় এসে বিসিবি এবং সরকারের সব অংশ থেকে দারুন সহযোগীতা পাবার কথা জানায় আইসিসির কাছে।

 এরপর সেই মূহুর্ত, ২৬ জুন ২০০০। লন্ডন, আইসিসির বার্ষিকসভায় আইসিসি প্রধান প্রস্তাব তুলেন ভোটাভুটির। বাংলাদেশের আবেদনের পক্ষে ৪৫ মিনিটের একটা রিপোর্ট উপস্থাপন করেন সাবের চৌধুরী। বেশকিছু প্রশ্ন করাহয় তাকে। বাংলাদেশ আশা করেছিলো ৭ ভোট কিন্তু মিটিং এর ভোট পর্বে ৯ দেশই বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাসের পক্ষে ভোট দেয়! পেয়ে গেল বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস। সেই দিন মিটিং-এ ছিলেন সাবের চৌধুরী এবং আশরাফুল হক আর বাইরে বসে ছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল।

 একটা কথা সত্যি বাংলাদেশ হয়তো পুরাপুরি প্রস্তুত ছিলোনা টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য। ছিলোনা শক্তিশালী ঘরোয়া ক্রিকেট, টেস্ট খেলাটা কি সেটাই বেশিরভাগ ক্রিকেটার আগে জানতেন না, প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা ছিলোনা। এটাও সত্যি যে বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস মূলত টেবিল রাজনীতির ফসল। তবে ওই সময়টা বাংলাদেশের পক্ষে ছিলো। জগমোহন ডালমিয়া আইসিসির সভাপতি ছিলেন, তিনি খুবই আন্তরিক ছিলেন। সেই সময়ে যারা টেস্ট স্ট্যাটাস আদায় করতে পারেনি তারা কেনিয়া। তাদের অবস্থান আজ কোথায়?



 অভিষেক টেস্ট খেলার জন্য ভারত এবং ইংল্যান্ড দলকে আমন্ত্রণ জানায় বিসিবি। কিন্তু ব্যস্ত সূচী দেখিয়ে ইংল্যান্ড না আসলে সাড়া দেয় ভারত। পাকিস্তান, জিম্বাবুয়ের পর তৃতীয় কোন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্ট ম্যাচেও প্রতিপক্ষ হয় ভারত।

 সাবের হোসেন চৌধুরী কে আমরা কজন চিনি কিংবা আশরাফুল ইসলাম? প্রয়াত জাগমোহন ডালমিয়ার সহযোগিতা, সাবের হোসেনের সর্বোচ্চ চেষ্টার মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছিল আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস। আজকের এই দিনে কৃতজ্ঞতা জানাই তাদের প্রতি, কৃতজ্ঞতা জানাই আকরাম, আমিনুল, নান্নুদের। আইসিসি ট্রফি কিংবা পাকিস্তানকে বিশ্বকাপে না হারালে হয়তো আমরা টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার দাবিটা পর্যন্ত তুলতে পারতাম না। তাদের জন্যই আজকের বাংলাদেশ ক্রিকেট দুরন্ত গতিতে চলার সুযোগ পেয়েছে।

No comments

Theme images by 4x6. Powered by Blogger.